মানুষের প্রাত্যহিক চাহিদা মেটানোর জন্য সম্পদ প্রয়োজন এবং এটি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সম্পদের ব্যবহারের ভিঞ্চিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ ভৌগোলিকভাবে কোন কোন ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলির সঙ্গে জড়িত তা জানা যাবে। আর এ থেকে জানা যাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ কী ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকার্ডের সঙ্গে জড়িত ाচ্ছে। ान ওঠা কোন কোন নিয়ামকের উপর নির্ভর করে এবং বিভিন্ন পণ্যের আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা কেন হয়, তা আমরা জানতে পারব।
যা কিছু নির্দিষ্ট প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সামাজিক অবস্থায় ব্যবহার করা যায় তাই সম্পদ। পেট্রোলিয়াম (খনিজ তেল)-এর ব্যবহার ও উত্তোলন জানার সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়েছে। অবস্থানগত কারণে কোনো ভূমির মূল্য কমবেশি হয়। তেমনি ব্যবহার জানার পর অপ্রয়োজনীয় বস্তুর প্রয়োজন হয়। এভাবেই কোনো বস্তু মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়। এক কথায় বস্তুর কার্যকারিতাই সম্পদ।
সম্পদের শ্রেণিবিন্যাস (Classification of resources)
সম্পদকে প্রাথমিকভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়— (১) প্রাকৃতিক সম্পদ, (২) মানব সম্পদ ও (৩) অর্থনৈতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, অনবায়নযোগ্য সম্পদ খুব ধীর গতিতে সৃষ্টি হয় এবং তাদের সরবরাহের পরিমাণ সীমাবদ্ধ। অনেক সম্পদ আছে যেগুলো সময়ে উত্তরণে কোনোভাবেই প্রভাবিত হয় না, যেমন— কয়লার মজুদ অথবা আকরিক ধাতু। আবার অনেক সম্পদ সময়ের উত্তরণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যেমন- চোয়ানোর মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। নবায়নযোগ্য সম্পদ বলতে বোঝাবে সেই জাতীয় সম্পদ, যা মূলত পুনঃসংগঠনশীল, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তারা বিশেষভাবে পরিবর্তনশীল। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে জলবিদ্যুৎ। অন্যদিকে জনসংখ্যাকে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানব সম্পদে পরিণত করা হয়।
প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছেঃ ১। নবায়নযোগ্য : সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, পানিশক্তি ২। অনবায়নযোগ্য : খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, জ্বালানি কাঠ
অর্থনৈতিক সম্পদ হচ্ছেঃ ভূমি, মূলধন,শ্রমিক,উদ্যোক্তা
কাজ : বিভিন্ন প্রকার সম্পদের দুটি করে উদাহরণ দাও (একক কাজ)।
সম্পদ সংরক্ষণের অর্থ প্রাকৃতিক সম্পদের এমন ব্যবহার, যাতে ঐ সম্পদ যথাসম্ভব অধিকসংখ্যক লোকের দীর্ঘ সময়ব্যাপী সর্বাধিক মঙ্গল নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়। সংরক্ষণ ধারণার অপর নাম জীবনাচরণ। শিক্ষা, মানবিক বৃত্তি, সত্যাচরণ, ন্যায়বিধান, সত্যানুসন্ধান, কর্তব্যপরায়ণতা বা প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার অপর নাম সংরক্ষণ। অর্থনীতিবিদদের মতে, সম্পদ অসীম নয়, সসীম। তাই সম্পদ ব্যবহারের উত্তম ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। উত্তম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য সম্পদের বৃদ্ধি সম্ভবপর। পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনাই উত্তম ব্যবস্থাপনা। অনবায়নযোগ্য সম্পদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হতে পারে, যেমন— তেল পোড়ানো। কিন্তু নবায়নযোগ্য সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সৌরবিদ্যুৎ এবং পানিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবহৃত বস্তুকে রিসাইক্লিং করে পুনরায় সম্পদরূপে ব্যবহার করা যায়, এতে সম্পদের অপচয় কম হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন সম্পদের বাছাইকরণ অর্থাৎ একের পরিবর্তে অন্যটির গুরুত্ব অনুধাবনের মাধ্যমে সম্পদের উপযোগিতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। অজৈব সারের প্রয়োগে প্রাথমিকভাবে ফলন বাড়লেও, পরবর্তীতে অধিক সারের প্রয়োগে জমির ক্ষতি সাধিত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে জৈবিক সারের বৃদ্ধি সাধনের ব্যাপারটি চিন্তা করা যায়। কৃষি মৃত্তিকা রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন রকমের মৃত্তিকা সংরক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন- সোপান চাষ ও শস্য আবর্তন। এছাড়া অকৃষি অঞ্চলে বনায়নের মাধ্যমে মৃত্তিকাকে সংরক্ষণ করা যায়। তাই বাংলাদেশের ভূমি, পানি, বিভিন্ন খনিজ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সকলকে সচেতন হওয়া উচিত এবং এগুলোর অপচয় রোধ করা গেলে আমাদের সম্পদের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে (3R : Reduse, Reuse, Recycle) সম্পদ সংরক্ষণে সম্পদের ব্যবহার হ্রাস, সম্পদের পুনব্যবহার ও সম্পদের পুননবায়ন এই তিন পদ্ধতির ব্যবহার জরুরি।
কাজ : সম্পদের অপচয় কীভাবে রোধ করা যায়? (দলীয় কাজ)
পণ্যসামগ্রী ও সেবাকার্যের উৎপাদন, বিনিময় এবং ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যে কোনো মানবীয় আচরণের প্রকাশই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তিন ভাগে বিভক্ত : প্রথম পর্যায়, দ্বিতীয় পর্যায় এবং তৃতীয় পৰ্যায় ৷
প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (Primary economic activities) : প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি কাজ করে। কৃষিকার্যের ক্ষেত্রে মানুষ বীজ বপন করে, প্রকৃতি এই বীজকে অঙ্কুরিত করে শস্যে পরিণত করে। প্রকৃতির এই অবদান মানুষ পুরস্কারস্বরূপ গ্রহণ করে। পশু শিকার, মৎস্য শিকার, কাঠ সংগ্রহ, পশুপালন, খনিজ উত্তোলন এবং কৃষিকার্য প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত।
দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (Secondary economic activities) : দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষ তার প্রথম পর্যায়ের কর্মকাণ্ড দ্বারা উৎপাদিত সামগ্রীকে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠন করে, আকার পরিবর্তন করে এবং উপযোগিতা বৃদ্ধি করে। খনিজ লৌহ আকরিক উত্তোলন করে তা থেকে লোহাশলাকা, পেরেক, টিন, ইস্পাত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে পরিণত করা হয়। রন্ধনকার্য থেকে আরম্ভ করে অত্যন্ত জটিল যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকরণ (Manufacturing) সকল প্রকার কার্যই দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (Tertiary economic activities) : তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষ প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মকাণ্ড থেকে উৎপাদিত বস্তুসমূহের উপযোগিতা বৃদ্ধি করে এবং সেবাকার্য সম্পাদন করে। কোনো দেশের উৎপাদিত পণ্যের উদ্বৃত্তাংশ ঘাটতি অঞ্চলসমূহে প্রেরণ করলে ঐ বস্তুর উপযোগিতা অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এটা সম্ভবপর হতে পারে ব্যবসা, বাণিজ্য, পরিবহন ইত্যাদির মাধ্যমে। পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, পরিবেশক, ব্যাংকার, শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, আইনজীবী, ধোপা, নাপিত, রিকশাচালক প্রভৃতি অসংখ্য প্রকার জনসমষ্টির কর্মকাণ্ড তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ।
কাজ : দোকানদার, কামার, শিক্ষক, কৃষক, ব্যবসায়ী, নার্স-এর অর্থনৈতিক কার্যকে নিচের ছকে উপস্থাপন
কর (দলীয় কাজ)।
প্রথম পর্যায় | দ্বিতীয় পর্যায় | তৃতীয় পর্যায় |
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের উপর বিশ্বকে অনুন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশসমূহের শতকরা ৫০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ প্রথম পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, যেমন— বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল, কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, জাম্বিয়া ইত্যাদি দেশ। এসব দেশের লোকজন কৃষিকার্য, মৎস্য শিকার, পশুপালন, কাঠ আহরণ ও কায়িক শ্রমে নিয়োজিত আছে। আর উন্নত বিশ্বের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, চীন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের শতকরা ৮০ ভাগের উপরে মানুষ দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। যেমন— কারখানার শ্রমিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, নার্স, ব্যবসা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, রাজনীতি, গবেষণা ও জনসেবায় নিয়োজিত থাকে। এসব দেশে শিক্ষার হার, জীবনযাত্রার মান ও মাথাপিছু আয় অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
শিল্প গড়ে ওঠার নিয়ামক (The factors of industrial development )
শিল্প প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ামকের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। প্রাকৃতিক নিয়ামকগুলো হলো— (১) জলবায়ু, (২) শক্তি সম্পদের সান্নিধ্য, (৩) কাঁচামালের সান্নিধ্য এবং অর্থনৈতিক নিয়ামকগুলো হলো- (৪) মূলধন, (৫) শ্রমিক সরবরাহ, (৬) বাজারের সান্নিধ্য, (৭) সুষ্ঠু যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, (৮) আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, (৯) সরকারি বিনিয়োগ নীতি, (১০) স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি।
(১) জলবায়ু : জলবায়ু বলতে এখানে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, জলীয়বাষ্প ও আর্দ্রতা ইত্যাদির প্রভাবকে বোঝানো হয়েছে। অধিক তাপমাত্রার কারণে উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলোতে কলকারখানা গড়ে তোলা কঠিন, কারণ কারখানার শ্রমিকরা অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। অথচ নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলীয় ও শীতপ্রধান দেশগুলোতে কলকারখানার শ্রমিকরা দীর্ঘক্ষণ পরিশ্রম করতে পারে। বস্ত্র শিল্প স্থাপনের জন্য আর্দ্র জলবায়ুর প্রয়োজন হয়, যদিও কৃত্রিম উপায়ে এখন কারখানার ভিতরে আর্দ্রতার ব্যবস্থা করা যায়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে শিল্পের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
(২) শক্তি সম্পদের সান্নিধ্য : শক্তি সম্পদের উপরও শিল্পের অবস্থান নির্ভরশীল। কারণ কারখানা চালানোর
জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। বড় বড় কারখানা চালানোর জন্য কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, জলবিদ্যুৎ ও পারমাণবিক শক্তি ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে। সস্তায় শক্তি সম্পদ ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন। যে সকল অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি সম্পদ সরবরাহের ব্যবস্থা আছে, সেখানেই সাধারণত বিভিন্ন প্রকার শিল্প কেন্দ্রীভূত হয়।
(৩) কাঁচামালের সান্নিধ্য : শিল্পকারখানার জন্য কাঁচামালের প্রয়োজন। তাই যে স্থানে কাঁচামাল পাওয়া যায়,
সেই স্থানে বা এর নিকটে শিল্প গড়ে ওঠে। যেমন- বাংলাদেশের রাঙামাটির চন্দ্রঘোনায় বাঁশ ও বেত প্রচুর
পরিমাণে পাওয়া যায় বলে সেখানে কাগজ শিল্প গড়ে উঠেছে।
অর্থনৈতিক নিয়ামকসমূহ (Economic factors)
(৪) মূলধন : শিল্প স্থাপনে মূলধনের প্রভাব বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কারণ ভূমি ও কারখানার যন্ত্রপাতি ক্রয়, শ্রমিকের বেতন এবং পরিবহন ব্যবস্থা প্রভৃতির জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। যে সকল স্থানে মূলধন সংগ্রহের ব্যবস্থা আছে সেখানেই শিল্প গড়ে ওঠে। কোনো দেশে মূলধনের অভাব হলে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
(৫) শ্রমিক সরবরাহ : কারখানায় কাজ করার জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে প্রচুর
শ্রমিক পাওয়া যায় বলে ঐ সকল দেশে অধিক শিল্প গড়ে ওঠে। কোনো কোনো শিল্পের জন্য প্রচুর সুদক্ষ
অথচ সস্তায় শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এবং পাট শিল্প এই জাতীয় শিল্প।
(৬) বাজারের সান্নিধ্য : শিল্পের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য উপযুক্ত চাহিদাসম্পন্ন বাজারের প্রয়োজন হয় । উপযুক্ত বাজার পাওয়া না গেলে শিল্পের টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ে। এজন্য বাজারের নিকটবর্তী স্থানে শিল্প সাধারণত গড়ে ওঠে। যে অঞ্চলে জনবসতি ঘন, সেই অঞ্চলে শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা বেশি।
(৭) সুষ্ঠু যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা : শিল্প স্থাপনের জন্য ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা ও সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা অপরিহার্য। যে দেশে সড়কপথ, রেলপথ, নৌপথ ও আকাশপথ যত উন্নত, সেই দেশে অধিকসংখ্যক শিল্প গড়ে উঠেছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো বলেই বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় এখানে বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে উঠেছে।
(৮) আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার : শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যতীত কোনো দেশের পণ্য বিশ্বের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। কারণ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। এজন্য জাপান, চায়না, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী ।
(৯) সরকারি বিনিয়োগ নীতি : শিল্পে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কোনো দেশের সরকারকে প্রণোদনামূলক কিছু নীতি গ্রহণ করতে হয়। কোনো দেশের ঘোষিত বিনিয়োগ নীতি বিনিয়োগকারীদের যত অনুকূল হয়, শিল্প স্থাপনের সংখ্যাও তত বৃদ্ধি পায়।
(১০) স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হচ্ছে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম নিয়ামক। পৃথিবীর যে দেশসমূহে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, সেই দেশসমূহে শিল্প স্থাপনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং তাতে দেশের অর্থনীতি মজবুত হয়।
শিল্পের শ্রেণিবিন্যাস (Classification of Industries)
খনিজ, কৃষিজ, প্রাণিজ ও বনজ প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রকারের শিল্প গড়ে ওঠে। সাধারণত শিল্পের আকার অনুসারে একে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— (১) ক্ষুদ্র শিল্প, (২) মাঝারি শিল্প, (৩) বৃহৎ শিল্প ।
(১) ক্ষুদ্র শিল্প : যে শিল্পে কম শ্রমিক ও স্বল্প মূলধনের প্রয়োজন হয়। এ শিল্পে শ্রমিক ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি ও উপকরণের সাহায্যে উৎপাদন সম্পন্ন করে থাকে। কম কাঁচামালে স্বল্প উৎপাদন করা হয়। এই ধরনের শিল্পগুলো গ্রাম ও শহর এলাকায় ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে ওঠে, যেমন— তাঁত শিল্প, বেকারি কারখানা, ডেইরি ফার্ম প্রভৃতি ।
(২) মাঝারি শিল্প : যে শিল্প শতাধিক শ্রমিকের সমন্বয়ে গঠিত হয়, তাকে মাঝারি শিল্প বলে। যেমন-
চামড়া শিল্প ও তৈরি পোশাক শিল্প ইত্যাদি।
(৩) বৃহৎ শিল্প : এই শিল্পে ব্যাপক অবকাঠামো, প্রচুর শ্রমিক ও বিশাল মূলধনের প্রয়োজন হয়, যেমন— লৌহ ও ইস্পাত শিল্প, বস্ত্র শিল্প, মোটরগাড়ি, জাহাজ ও বিমান শিল্প প্রভৃতি। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার আয় এবং হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। এই শিল্প সাধারণত শহরের কাছাকাছি স্থানে গড়ে ওঠে।
আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য (Import and export trade)
পৃথিবীর কোনো দেশই সকল সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রটোকল মেনে তাদের জনগণের চাহিদা অনুসারে পণ্য আমদানি এবং উদ্ধৃত পণ্য অন্য দেশে রপ্তানি করে থাকে। আর এটাকেই আমরা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বলে থাকি। যেমন— জাপান লৌহ ও ইস্পাতের তৈরি ভারী যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক্সসামগ্রী, মোটরগাড়ি, জাহাজ ও বিভিন্ন শিল্পদ্রব্য রপ্তানি করে এবং এ দেশ বিভিন্ন দেশ থেকে লোহা ও কয়লা আমদানি করে। বাংলাদেশ চাল, গম, ভোজ্যতেল, সুতা, পেট্রোলিয়াম শিল্পসামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি আমদানি এবং তৈরি পোশাক, কৃষিজাত পণ্য, চা, চামড়া, সিরামিকসামগ্রী, জুতা, হিমায়িত খাদ্য, কাঁচাপাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি রপ্তানি করে। এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পরস্পরের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনা করে।
বাণিজ্যিক ভারসাম্য ও উন্নয়নের সম্পর্ক (Trade balance and development of relationship )
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্য সমান নয়। অর্থাৎ আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান থাকে। বিশ্বের যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের উপর আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য এবং সেই সঙ্গে উন্নয়ন সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর দেশের সঙ্গে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসম বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। তবে উন্নয়ন সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে অসম বাণিজ্যিক সম্পর্কের ব্যবধান কমতে পারে। চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অসম বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান। কারণ এই সব দেশ থেকে বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করে থাকে। এটাকে বাণিজ্য ঘাটতি বলে। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রপ্তানি বাণিজ্যে এগিয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সাথেও বাণিজ্যে উদ্বৃত অবস্থানে রয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি ও আমদানির অনুপাতের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ভারসাম্য বিদ্যমান (সারণি ১)।
সারণি ১ : বাংলাদেশের গত ৬ বছরের বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা
বছর | আমদানি (মিলিয়ন ইউএস ডলার) |
রপ্তানি (মিলিয়ন ইউএস ডলার) |
রপ্তানি অপেক্ষা আমদানি ব্যয় বেশি (মিলিয়ন ইউএস ডলার) |
২০১৫ | ৪০৬৮৫.০ | ৩১২০৮.৯ | ৯,৪৭৬.১ |
২০১৬ | ৩৯৭১৫.০ | ৩৪২৫৭.২ | ৫,৪৫৭.৮ |
২০১৭ | ৪৩৪৯১.০ | ৩৪৬৫৫.৯ | ৮,৮৩৫.১ |
২০১৮ | ৫৪৪৬৩.২ | ৩৬৬৬৮.২ | ১৭,৭৯৫.০ |
২০১৯ | ৫৫৪৩৮.৫ | ৪০৫৩৫.০ | ১৪৯০৩.৫ |
২০২০ | ৫০৬৯১.০ | ৩৩৬৭৪.১ | ১৭০১৬.৯ |
উৎস : ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক, বার্ষিক রিপোর্ট, ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত
আরও দেখুন...